মানুষ নাকি তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্ন যদি থাকে আকাশ ছোঁয়ার, আর সে জন্য যদি কেউ পরিশ্রম করে যায় অবিরাম, তাহলে একদিন সেই স্বপ্নের পাখি ধরা দেবেই, নিশ্চিত করে এটা বলাই যায়।
প্রতিটি মানুষই কমবেশি প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রতিভার সাথে পরিশ্রম আর স্বপ্ন দেখার সাহস যখন যোগ হয়, তখনই মূলত মানুষ সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন, যাদের স্রষ্টাপ্রদত্ত প্রতিভা কম, কিন্তু পরিশ্রম সেই ঘাটতি পুষিয়ে দেয় খুব ভালোভাবেই। আবার অনেকে প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, কিন্তু পরিশ্রম করতে না পারায় প্রতিভাকে সাফল্যে অনূদিত করতে পারে না। প্রতিভা, পরিশ্রম আর স্বপ্ন দেখার বাইরে আরও একটা ব্যাপার সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। সেটা হলো, মানুষ জন্মগতভাবেই ধনী কিংবা দরিদ্র হয়ে জন্ম নেয়। জীবনে সফলতা বা ব্যর্থতার পেছনে এই ব্যাপারটাও কম ভূমিকা রাখে না।
আমাদের দেশে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ব্যাডমিন্টন ও গ্রামগঞ্জের কাবাডির বাইরে অন্য খেলাগুলো খুবই অবহেলিত, অপ্রচলিত খেলা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এমনকি পৃথিবীর অন্যতম অভিজাত খেলা গলফ নিয়েও মানুষের আগ্রহ কম। এই খেলাটি বোঝেন, এরকম মানুষ আমাদের চারপাশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবু আজ এক গলফারকে নিয়েই এই লেখাটি। আরও অনেক আগেই যাকে নিয়ে লেখা উচিত ছিল, লিখেছেনও অনেকে। যিনি গলফ মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়েছেন, যার জন্য বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে গলফের জন্যও চেনে, তিনিই হলেন সিদ্দিকুর রহমান। সিদ্দিকুর রহমান কে বাংলা ডায়েরি আজকের আয়োজন |
সিদ্দিকুর রহমানের জন্ম ও শৈশব
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর সিদ্দিকুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরে। পারিবারিক নাম মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান। তার বাবার নাম আফজাল হোসেন এবং মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে সিদ্দিকের অবস্থান তৃতীয়। জন্ম থেকেই প্রচন্ড অভাবের মধ্যে বেড়ে উঠেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর বাবা আফজাল হোসেন পুরো পরিবার নিয়ে পেটের দায়ে এসে উঠেছিলেন ঢাকার খানিক বাইরে ধামালকোটের বস্তিতে। সেই সন্ত্রাসময় স্থানটিতে বেড়ে ওঠতে ওঠতে সিদ্দিক একসময় পাশের বাড়ির এক ছেলের সাথে চলে যান ঢাকাস্থ কুর্মিটোলায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর গলফ ক্লাবে। সেখানে তিনি ‘বলবয়’ হিসেবে বল কুড়ানোর কাজ করতে শুরু করেন, তখন তিনি পড়তেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। বিনিময়ে পেতেন প্রতিদিন ত্রিশ টাকা মজুরি। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা বাসায় রেখে, কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়েই দৌড় দিতেন গলফের মাঠে৷ এভাবেই একদিন ‘বলবয়’ থেকে ‘প্রমোশন’ পেয়ে ‘ক্যাডি’ হয়ে যান। সাধারণত গলফারদের গলফ ক্লাব, ব্যাগ ও সরঞ্জাম বয়ে বেড়ান ও মেইনটেন্যান্স করাই ক্যাডির কাজ। আনন্দের সাথেই সে কাজটি করলেও নিজে খেলার একটা তাড়না অনুভব করতেন তিনি।
কিন্তু গলফ ক্লাব আর সরঞ্জামগুলো তো অনেক দামী! বুদ্ধি বের করেন তিনি। লোহার রড দিয়ে কামারের কাছ থেকে কোনোরকমে চলনসই একটা গলফ ক্লাব বানিয়ে সেটা দিয়েই খেলতে শুরু করেন তিনি। ক্যাডিবয়ের কাজের পাশাপাশি নিজের গলফ-চর্চাও চলতে থাকে সমানতালে।
গলফের প্রাথমিক জীবন
এই শতকের শুরুর দিকে গলফ ফেডারেশন দেশে পেশাদার গলফার তৈরির জন্য উদ্যোগ নেয়। প্রথমেই বলবয়, ক্যাডিদের মধ্য থেকে খেলোয়াড় বাছাই করা শুরু হয়। সেই বাছাইয়ে টিকে যান সিদ্দিক, শুরু হয় প্রশিক্ষণ। তার একাগ্রতা, পরিশ্রম ও অনুশীলনে দারুণ খেলা দেখে অপেশাদার গলফের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলতে পাঠানো হয়। একের পর এক অপেশাদার টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে থাকেন। সার্কভুক্ত সকল দেশেই অপেশাদার গলফ টুর্নামেন্ট জেতেন তিনি, করেন অনন্য রেকর্ড। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল আর নিজ দেশ মিলিয়ে ১২টি অপেশাদার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেকে পেশাদার গলফের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। ২০০৭ সালের দিকে প্রবেশ করেন গলফের পেশাদার জগতে। সেখানেও কয়েকটা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। বিশেষ করে প্রথম বাংলাদেশি গলফার হিসেবে ২০০৮ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত ৩০ লাখ রুপির প্রফেশনাল গলফ ট্যুর অব ইন্ডিয়ায় প্রফেশনাল প্লেয়ার্স চ্যাম্পিয়নশিপের টাইটেল জিতে প্রথম বিজয়ের স্বাদ পান। এর পর ইন্ডিয়ান সার্কিটে আরও দু’টি বিজয়সহ অন্যান্য টুর্নামেন্টে সফলভাবে অংশগ্রহণ করে পেশাদার গলফের ভুবনে দারুণভাবে পরিচিতি পান।
২০০৮ সাল থেকে শুরু করেন এশিয়ান ট্যুরে অংশগ্রহণ। এশিয়ান গলফের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা এশিয়ান ট্যুরের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ভালো খেলতে থাকেন নিয়মিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় সাফল্যের দেখা পান ২০১০ সালের ১লা আগস্ট, প্রথম এশিয়ান ট্যুর ব্রুনেই ওপেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে। সিদ্দিকুর রহমানের সৌজন্যে গলফের ভুবনে জায়গা করে নেয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
এরপর একের পর এক এশিয়ান ওপেনের টুর্নামেন্টে দারুণ খেলতে থাকেন, এশিয়ান র্যাঙ্কিংয়ে একসময় নয় নাম্বারে ওঠে আসেন। শুধু তাই নয়, হতদরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে আসা এক ‘ওয়ান্ডার বয়’ লাখ লাখ ডলার প্রাইজমানি পেতে শুরু করেন। আয় বাড়তে থাকে হু হু করে।
একদিন পান দারুণ সুসংবাদ। এশিয়ান র্যাঙ্কিংয়ে সেরাদের কাতারে থাকার সুবাদে ২০১৩ গলফ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়ে যান।
গলফ বিশ্বকাপের ঠিক আগেই আরেকটি বড় সাফল্য এসে যোগ হয় সিদ্দিকুর রহমানের ক্যারিয়ারে। এশিয়ান ট্যুরের অন্যতম জনপ্রিয় ও বড় টুর্নামেন্ট হিরো ইন্ডিয়ান ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজের দ্বিতীয় এশিয়ান ট্যুরের শিরোপা জয় করে নেন। অনির্বাণ লাহিড়ি ও চৌরাশিয়ার মতো ভারতীয় গলফারদের হারিয়ে ঐ টুর্নামেন্ট জেতা ছিল দারুণ একটি সাফল্য। ভারতের বিখ্যাত পত্রিকা টাইমস অফ ইন্ডিয়ার বাংলা ভার্সন এই সময় সিদ্দিককে ‘বাংলার টাইগার উডস’ উপাধিতে ভূষিত করে তখন। আর সিদ্দিকও স্বপ্ন দেখেন, একদিন টাইগার উডস, লি ওয়েস্টউড, গ্রেগ নরম্যান, আর্নি এলস’দের মতো কিংবদন্তি গলফারদের সাথে খেলবেন।
বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা অলিম্পিকে বরাবরই ওয়াইল্ড কার্ড নামক দাক্ষিণ্যের সৌজন্যে খেলতে যায়। কিন্তু ২০১৬ সালে ব্রাজিলের রিও অলিম্পিকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সিদ্দিকুর রহমান সরাসরি খেলার সুযোগ পান। বিশ্বে ২০০টির বেশি দেশে পেশাদার গলফারের সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি, তার মধ্যে মাত্র ৬০ জন সুযোগ পান অলিম্পিকে খেলার। এই ৬০ জনের মধ্যে প্রায় ৩০ জন শুধু আমেরিকা থেকেই অংশ নেন। বাকি ৩০ জনের মধ্যে একজন গলফার হিসেবে ২০১৬ সালের অলিম্পিকে দেশের পতাকার প্রতিনিধিত্ব করে দেশকে দারুণ সম্মানিত করেন সিদ্দিকুর রহমান।
গলফ খেলতে খেলতেই কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে এক অ্যামেচার গলফার তরুণীর সাথে পরিচয় হয় সিদ্দিকের। তরুণীটির নাম অরণি। দুই পরিবারের সম্মতিতে সে পরিচয় পরিণয়ে গড়ায়। গলফার দম্পতির বিয়ে হয় ২০১৫ সালের ২০শে জানুয়ারি। অরণি নিজে জাতীয় অ্যামেচার ওপেনে তিনবার রানার্সআপ, বাংলাদেশ গেমসে সেনাবাহিনীর হয়ে ব্রোঞ্জ ও দলগতভাবে সোনা জেতা গলফার। বিয়ের পর অবশ্য অরণি কোচিংয়ে ঝুঁকে গেছেন। সেই সাথে সিদ্দিকের ব্যাকআপ হিসেবে বিভিন্ন ট্যুরে নানাবিধ কার্য সম্পাদনাও করে থাকেন তিনি।
গলফ একটি ব্যয়বহুল খেলা। নিতান্তই দরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে আসা সিদ্দিককে দেখে অনেকেই এখন গলফের দিকে ঝুঁকছেন। দেশে এখন নিয়মিত প্রায় প্রতি বছরই এশিয়ান ট্যুরের টুর্নামেন্ট হয়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেকেই ওঠে আসতে পারছেন না। সিদ্দিকের সাথে শুরুতে দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর ছিল, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এত দূর আসতে পেরেছেন বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছেন। পর্যাপ্ত সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সিদ্দিকের মতো আরও গলফার ওঠে এসে বিশ্বদরবারে দেশকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাবেন, এটা বলে দেয়াই যায়।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সিদ্দিকুর রহমান ১২টি অপেশাদার গলফ টুর্নামেন্ট জয় করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে জিতেছেন ৫টি, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় জিতেছেন ২টি করে, আর একটি জিতেছেন ভারতে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বাংলাদেশী গলফার হিসেবে সুযোগ পান এশিয়ান ট্যুর-এ অংশ নেয়ার। এবং এ বছরই ব্রুনাই ওপেন শিরোপা জিতে নেন। একই বছর তিনি এশীয় গলফারদের র্যাঙ্কিংয়ে ৯-তে উঠে আসেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এশিয়ান ট্যুর-এ স্থান পাবার পর পরই ১ আগস্ট প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তিনি জয় করেছেন এশিয়ান ট্যুর-এর শিরোপা। ২০১৩ সালের নভেম্বরে হিরো ইন্ডিয়া ওপেন গলফ টুর্নামেন্টে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৬ রিও গেমসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পতাকা বহন করেন তিনি।
টানা খেলার ধকল ও নানা ইনজুরিতে আক্রান্ত সিদ্দিকের ফর্ম একটু পড়তির দিকে এখন। যদিও আবারও ঘুরে দাঁড়াবার সকল সুযোগই আছে তার সামনে। ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, কিংবা না-ই পারেন, ইতঃমধ্যে সিদ্দিক যা করেছেন, তাতে দেশের গলফের ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি মহাতারকা হয়েই যে বেঁচে থাকবেন, তাতে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই কারোরই। শুভকামনা সিদ্দিকুর রহমানের অনাগত দিনগুলোর জন্য।