দুটি এশিয়ান ট্যুর, ছয়টি অপেশাদার টুর্নামেন্ট, বারোটি অপেশাদার টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন, দেশের একমাত্র গলফার হিসেবে খেলেছেন বিশ্বকাপ। দেশসেরা একমাত্র ক্রীড়াবিদ হিসেবে ওয়াইল্ড কার্ড ছাড়া সরাসরি খেলেছেন অলিম্পিকে। শুধু তাই নয় র্যাংকিংয়ে এশিয়ার সেরা দশজন গলফারদের মধ্যেও ছিলেন অনেক দিন। এতো এতো সাফল্য যার ঝুলিতে, যিনি বাংলাদেশের গলফের সবচেয়ে বড় তারকা। হয়েছেন দ্য গ্রেট। তারও ছিল এক কষ্টের অতীত। রয়েছে অবিশ্বাস্য এক সংগ্রামের গল্প। তিনি আর কেউ নন, আমাদের দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান।
ঢাকার কাফরুমে ধামাল কোট বস্তিতে ১৯৮৪ সালের ২০ নভেম্বর জন্ম হয় তাঁর। বাবার নাম আফজাল হোসেন। মায়ের নাম মনোয়ারা। আফজাল-মনোয়ারা পরিবারের ৪ সন্তানের মধ্যে সিদ্দিকুর তৃতীয়। কখনো বেবি টেক্সি, কখনো রিক্সা চালিয়ে সংসার টেনেছেন আফজাল। অভাব-অনটন ছিল পরিবারের নিত্য সঙ্গী। একবেলা খাবার জুটলে কয়েক বেলা উপোস থাকতে হতো। তার উপর সন্তানদের লেখা পড়ার খরচ চালানো। কোন ভাবেই এগিয়ে নিতে পারছিলেন না আফজাল হোসেন। পরিবারের এই কঠিন অবস্থায় সেই ছোট বেলা থেকেই সিদ্দিকুর চেয়েছিলেন পাশে দাঁড়াতে। প্রতিবেশি এক বন্ধুর সাথে চলে যান ঢাকার কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে। প্রতিবেশি সেই বন্ধুর কাছে সিদ্দিকুর জানতে পারেন এই ক্লাবে যারা খেলেন তাদের খেলতে সাহায্যকলে দিনে দশ টাকা উপার্জন করা যায়। খাবার পাওয়া যায়। সিদ্দিকুর রাজি হয়ে যান। শুরু হয় সিদ্দিকুরের নতুন জীবন। প্রথমে দিনে দশ টাকা। পরে কদিনের মাথায় সিদ্দিকুর আয় করতে শুরু করেন দিনে ত্রিশ টাকা। তখন সিদ্দিকুর তৃতীয় শ্রেনির ছাত্র।
একজন বল বয় হিসেবে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ানোর সুযোগ হয় তার। দেখতে দেখতে শেখাও হয়ে যায় গলফের নিয়ম কানুন। দিন এগুতে থাকে। বলবয় থেকে সিদ্দিকুর তখন কে ডি। গলফারদের সাথে তাদের ফিট ব্যাগ নিয়ে যারা সাহায্য করে তাদের কেডি বলা হয়। লেখাপড়ার আসল ক্লাসটি সেখানেই হয় সিদ্দিকুরের। অভিজাত সব মানুষের সান্নিধ্য সিদ্দিকুরকে মার্জিত হতে শেখায়। এদিকে গলফের প্রতি চরম ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায় তার। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই তো আর হবে না। এর জন্য সকল সরঞ্জাম দরকার। টাকার অভাবে সংসারে টানাপোড়েন। সেখানে গলফ খেলতে চাওয়া নিশ্চিত বড়লোকি দেখানো মনে হতে থাকে সিদ্দিকুরের কাছে। নিজেকে বোঝাতে নিজের সাথেই যুদ্ধ শুরু হয় তাঁর। যুদ্ধে হেরে যান সিদ্দিকুর। কিন্তু গলফ ক্লাব স্টিক (যে দন্ডটি দিয়ে বল হিট করা হয়) গুলোর অনেক দাম। কি করা যায় ভাবতে থাকেন। সিদ্দিকুরের মাথায় আসে কামারের কাছে গিয়ে বানিয়ে নিলে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ সিদ্দিকুর এক কামারের কাছে গিয়ে তৈরি করে নেন নিজের জন্য একটি ক্লাব স্টিক। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রাকটিসও শুরু করেন। এদিকে কেডি হিসেবে কাজ করতে করতে চোখের সামনে গলফের ব্যবচ্ছেদ শিখে ফেলেন সিদ্দিকুর। বয়স যখন ১১ সিদ্দিকুর সুযোগ পান কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার।
২০০০ সালে বয়স যখন ষোল সিদ্দিকুর গলফ খেলার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ পান। একে একে জিতে যান বারোটি অপেশাদার শিরোপা। ২০২১ সালে এশিয়ান ট্যুরে অংশ নেয়ার সুযোগ এলে এশিয়ার জন্য সম্মান বয়ে আনেন তিনি। পাশাপাশি সে বছরই ব্রুনাই ওপেনেও শিরোপা জিতে নেন তিনি। এশিয়ার গলফ র্যাংকিংয়ে হয়ে যান নবম খেলোয়াড়। একজন বলবয় থেকে কেডি এবং তারপর দেশসেরা গলফার হওয়ার পেছনে প্রতিবেশি কামাল মিয়া আর কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের সোমবারের দিনটি সিদ্দিকুর বহমানের কাছে সব থেকে প্রিয়। কামাল মিয়া না হলে এই ক্লাবে কাজ পাওয়া হতো না। আর সোমবারের এক ঘণ্টা গলফ খেলতে না পারলে আজ সিদ্দিকুর রহমান হওয়া হতো না।
১৯৯৯ সালে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের কর্মচারীদের প্রতিভা অন্বেষন সময়টিকেও কোন দিন ভুলতে পারবেন না তিনি। ১৫০ জনের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন সিদ্দিক। এরপর ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাকে কুর্মিটোলা ক্লাবের সদস্য করে নেয় এবং বাংলাদেশ দলের জন্য মনোনীত করেন। সিদ্দিকুর রহমানের শুরুটা এখান থেকেই। অসংখ্য টুর্নামেন্ট আর অসংখ্য অর্জনের সাথে এগিয়ে চলতে থাকেন তিনি। ক্রীড়া ক্ষেত্রে অসামান্য নৈপুন্যের জন্য কলকাতার ‘এই সময়’ পত্রিকা সিদ্দিকুর রহমানকে বাংলার টাইগার উডস্ নামে অভিহিত করেন।
জীবনের চূড়ান্ত পদক্ষেপটাও সিদ্দিকুরের গলফ কোর্স থেকেই। গলফার সামাউন আঞ্জুম অরণির সাথে এখানে পরিচয় হয় তার। বিয়ে করেন তারা। সিদ্দিকুরের খেলা দেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নাগরিকত্বের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন অনেকবার। বলেছেন বাংলাদেশে জন্মেছি, বাংলাদেশের জন্য কিছু করে মরতে চাই। বিদেশের মাটিতে সিদ্দিকুর যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। চেষ্টা আর পরিশ্রম আজ সিদ্দিকুর রহমানকে করেছে বিশ্বনন্দিত। ধামাল কোট বস্তির সেই কষ্টের দিন গুলো এখন নেই। তবে সেই দিন গুলো না আসলে আজকের সিদ্দিকুর রহমানের এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে ওঠা হতো কী! বাংলার টাইগার উডসের প্রতি রইল আমাদের শুভ কামনা।
Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Related Posts
Advertisements
Advertisements
Recent Posts
Charlie Woods Celebrates First Hole-in-One at PNC Championship
December 24, 2024
Bryson DeChambeau Set to Compete in International Series India
December 23, 2024
Team Bernhard Langer Clinches Historic Victory at PNC Championship
December 23, 2024
JINAT BATΙΚΑ A PERFECT BLEND OF COMFORT AND TRANQUILITY
December 23, 2024
Golf for All Bringing the Game to Everyone
December 22, 2024