বলা হয়- গলফ বিলাসবহুল খেলা। আক্ষরিক অর্থেও ব্যাপারটি তেমন। একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের কাছে এই খেলাটির বেশ কদর। সুবজের বুকে সাদা বল নিয়ে পারদর্শিতা দেখানোর চেয়ে এই খেলায় অংশ নেওয়াটাই অনেকের কাছে ‘বিশেষ কিছু’। এক ধরনের অভিজাত ব্যাপার আছে গলফে। বিলাসবহুল এই খেলায় যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়, সেসব কিনে এই খেলায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের অনেকের কাছে কল্পনার মতোই। আবার গলফ ক্লাবে নাম লেখাতেও বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়।
সব মিলিয়ে গলফ হয়ে উঠেছে অভিজাত খেলা। যদিও এসব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে চীনের গুয়াংজু শহরের নানশা গলফ ক্লাব। যেখানে গলফ রাজকীয় বা অভিজাত শ্রেণির কোনো খেলা নয়। নানশা শহরে গড়ে উঠা এই গলফ ক্লাবে খেলতে পারেন যে কেউ। সদস্য হতে কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। নেই মাসিক কোনোও চাঁদাও। খেলার উপকরণ না থাকলেও সমস্যা নেই। নানশা গলফ ক্লাবে গিয়ে পৌঁছালেই সব সমস্যার সমাধান। এক কথায় সবার জন্য উন্মুক্ত এই গলফ ক্লাবটি।
আর এই ব্যাপারটিই গুয়াংজুতে গলফের বিপ্লব এনে দিয়েছে। নানশাবাসীদের প্রিয় খেলা হয়ে উঠেছে গলফ। গলফ নিয়ে তাদের মধ্যে আগ্রহের শেষ নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ, গলফ স্টিক হাতে সবাই সবুজের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বয়স্করা শখের বসে নানশা গলফ ক্লাবে গেলেও খেলাটির চর্চা অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছেন। আর শিশু বা কিশোরদের মাঝে নানশা গলফ ক্লাবটি স্বপ্নের প্ল্যাটফর্ম। যে প্ল্যাটফর্ম থেকে দীক্ষা নিয়ে বিশ্ব গলফে সাফল্যের ছাপ রাখতে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
বাবা-মায়েরাও সন্তানদের চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। ছেলে মং উ’কে অনুশীলন করাতে নিয়ে আসা উয়াং চু বললেন তার স্বপ্নের কথা, ‘এই গলফ ক্লাবটির কারণে গুয়াংজুতে গলফের উত্থান হয়েছে, এটা আপনি বলতে পারেন। যার ইচ্ছা হয় গলফ খেলতে, সে এখানে এসে খেলতে পারে। আমার ছেলে গত ছয় মাস ধরে এখানে অনুশীলন করছে। বেশ ভালো করছে বলেই আমার ধারণা। কারণ কোচরা বলেছেন, পেশাদার গলফার হওয়ার মতো সামর্থ্য ওর মধ্যে আছে। ওকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছি এই গলফ ক্লাবটির কারণেই।’
যদিও গলফ চীনে ততটা জনপ্রিয় ছিল না। এমনকি এখনো পছন্দের সেরা তিনের মধ্যে নেই খেলাটি। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনের জনপ্রিয় খেলা রাগবি। তাদের পছন্দের তালিকার দুই নম্বরে আছে বাস্কেটবল, তিনে ফুটবল। উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের পরিচয় হতে শুরু করেছে কেবল সেখানে। তবে গলফ পেয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। গলফে তরতর করে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।
মাত্র ৩৪ বছর (১৯৮৪ সালের দিকে) আগে এশিয়া মহাদেশের এই দেশটিতে গলফের চর্চা শুরু। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প। শীর্ষ ৫০ বাছাইয়ের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন চীনের পেশাদার গলফার লি হাওতং। কোনো আন্তর্জাতিক আসরের শিরোপা জিততে না পারলেও সেরা ৫০-এর মধ্যে হাওতংয়ের থাকাটা বড় প্রাপ্তি চীনাদের কাছে। চীনাদের কাছে হাওতং হয়ে উঠেছেন গলফের রোল মডেল। চীনের প্রথম গলফার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লেডিস প্রফেশনাল গলফ অ্যাসোসিয়েশনের (এলপিজিএ) সদস্য হওয়া মহিলা গলফার ফেং শানশানকে দেখেও অনুপ্রেরণা নিচ্ছে চীনের শিশু-কিশোররা।
গলফ খেলাটাকে গোটা চীনে ছড়িয়ে দিতে তাদের সরকার অনেক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারিভাবে ৪৯৫টি গলফ কোর্স গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে একটি নানশা গলফ ক্লাব। পাহাড়ের বুকে গড়ে উঠা এ গলফ ক্লাবটি তৈরি করেছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। উদ্দেশ্য কেবলই গলফার তৈরি করা। এখান থেকে কোনো ধরনের অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য তাদের নেই। যে কারণে বিনামূল্যে এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অর্থের যোগানে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ। এ ছাড়া স্পন্সর থেকেও আসে বড় অঙ্কের অর্থ।
নানশা গলফ ক্লাবে স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে পেশাদার গলাফাররা প্রতিদিন অনুশীলন করেন। ১৯ লক্ষ ৭০ হাজার স্কয়ার মিটারের এই ক্লাবে ১২ জন পেশাদার কোচ আছেন। শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একজন হাই প্রোফাইল কোচকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্কুলের বাচ্চারা অনুশীলন করে ভোরে। এরপর কিশোর গলফাররা অনুশীলনের সুযোগ পান। বেলা যত গড়াতে থাকে ততই ভিড় জমতে থাকে পেশাদার গলফারদের।
চীনের বিভিন্ন গলফ ক্লাব বছরে দুইবার ক্যাম্পের আয়োজন করে থাকে প্রতিভাবান তরুণ গলফারদের নিয়ে। নানশা গলফ ক্লাবও এই ক্যাম্পে অংশ নেয়। সাধারণত গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে ক্যাম্প হয়ে থাকে। দুই-তিন সপ্তাহের জন্য আয়োজন করা এসব ক্যাম্পে প্রচুর ছেলে ও মেয়ে গলফার অংশ নেয়। যেখান থেকে অনেক উদীয়মান গলফার বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে নানশা গলফ ক্লাব।
চীনের গলফারদের একাডেমির মাধ্যমে আর্থিক কোনো সহযোগিতা করা না হলেও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করে থাকে। জুনিয়র গলফ প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা ভালোমানের গলফারদের বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি স্পন্সর করে। একাডেমিগুলো সহযোগিতা করে স্পন্সর পাওয়ার ক্ষেত্রে। নানশা গলফ ক্লাবও তাদের ব্যতিক্রম নয়।
এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে চীনের অন্যতম সেরা গলফ ক্লাবে পরিণত হয়েছে নানশা গলফ ক্লাব। এখানে রয়েছে ৩৬ হোলের দুটি কোর্স। বছরে সিনিয়র ও জুনিয়র মিলিয়ে ২৮টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। স্কুল-কলেজ টুর্নামেন্ট ও বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টও আয়োজন করা হয়। গুয়াংজুর অনেক স্কুলেই গলফ খেলার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করা হয় নানশা গলফ ক্লাবের পক্ষ থেকে।
ক্লাবটির দেখভালের কাজ করে যাচ্ছেন সোফি কানপেং। অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা এই নারী কর্মকর্তা ক্লাবটির সফলতা নিয়ে বলেন, ‘জুনিয়র গলফারদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা করার পুরস্কার হিসেবে আমরা সেরা ইনস্টিটিউটের পুরস্কার পেয়েছি। এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। যা পরবর্তী সময়ে আমাদের আরও সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ওই অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর আমরা দারুণ সাড়া পেয়েছি। অনেকেই এসেছেন তাদের সন্তানদের গলফ শেখানোর জন্য।’
এই গলফ ক্লাব নিয়ে গর্বের শেষ নেই কানপেংয়ের। তিনি বলেন, ‘অনেক কিছুই আছে, যা আমাদের অর্থাৎ এই গলফ ক্লাবকে আনন্দ দেয়। আমাদের সবচেয়ে ভালো স্মৃতি গুয়াংজুর পেশাদার গলফার ফেং শানশানকে নিয়ে। চীনের প্রথম গলফার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লেডিস প্রফেশনাল গলফ অ্যাসোসিয়েশনের (এলপিজিএ) সদস্য হওয়া শানশান জুনিয়র গলফার থাকা অবস্থায় এখানেই অনুশীলন করতেন। এখন তিনি কত বড় গলফার। তবে গলফ নিয়ে বলতে গেলে এই ক্লাবের কথা সবার আগে বলেন তিনি।’
এই ক্লাব নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন গলফের অন্তপ্রাণ কানপেং, ‘এই গলফ ক্লাবকে আমরা প্রথমে চীনের সেরা হিসেবে দেখতে চাই। এরপর বিশ্বের সেরা গলফ ক্লাব হতে চাই। আমরা সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের পরিকল্পনা তেমনই। আমাদের একটি গলফ একাডেমি আছে, যারা ফেং শানশানের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে। এই গলফ ক্লাবে মোট ১২জন কোচ আছেন, সবাই পেশাদার।’
নানশা গলফ ক্লাব বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত, দেখিয়ে দিচ্ছে স্বপ্ন দেখার পথ। আর সেই পথে হেঁটে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে খুদে হাজারো গলফার। প্রতি মাসে ৬ হাজার গলফার অনুশীলন করে যাচ্ছেন এই ক্লাবে। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। যাদের চোখেমুখে কেবলই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন।