আমাদের দেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে ক্রিকেট, ফুটবল যতটা জনপ্রিয় ততটা জনপ্রিয় না গলফ খেলা। তবে গলফ বাংলাদেশের কাছে একেবারে অপরিচিতও না। একটু পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে কোনো না কোনো সময় এই গলফ বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদীদের মধ্যে হট টপিক ছিল।
গলফার সিদ্দিকুর রহমানের বদৌলতে বাংলাদেশ বহু শিরোপা এই গলফের আদলেই পেয়েছে। সে সময় ব্রুনাই ওপেন জিতে বাংলাদেশে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন গলফার সিদ্দিকুর। বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে সরাসরি অংশগ্রহন করার সুযোগ পান তিনিই।
২০১২ অলিম্পিকে বাংলাদেশ দলের ফ্লাগ ধরার কৃতিত্বও সিদ্দিকুর রহমানের। তারপরও গলফ খেলাটা এখনো সর্বসাধারণের কাছে পৌছাতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে এর নিয়মকানুন।
ক্রিকেট খেলার চার, ছক্কা, উইকেট কিংবা ফুটবল খেলার গোল বুঝা যতটা সহজ, গলফের পার, কোর্স, বগি বুঝা ততটাই কঠিন। তাই আজকে গলফের ইতিহাস, নিয়ম, স্কোরিং- সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করব এই ফিচারে।
গলফ ইতিহাস
ইতিহাস বলে বল ও স্টিকের এই সূক্ষ্ম দক্ষতার খেলাটির প্রচলন হয় রোমান খেলা ‘পাগানিকা’ থেকে। অন্য একটি মত বলছে, অষ্টম ও চতুর্দশ শতাব্দীতে চীনে প্রচলিত ছিল ‘চুইওয়ান’ নামের একটি খেলা। এই ‘চুইওয়ান’ থেকেই প্রচলিত হয় গলফ খেলাটি। তবে অধিকাংশের মতে, গলফ খেলার প্রচলন শুরু হয় স্কটল্যান্ডে এবং সময়টি ছিল দ্বাদশ শতাব্দী। সেখানে মেষ পালকরা কাজের ফাঁকে সময় কাটানোর জন্য পাথর ও লাঠি দিয়ে এই ধরনের খেলা খেলতো। তারা যেই মাঠে মেষ চড়াতো সেই মাঠে খরগোশের গর্ত ছিল। তারা সময় কাটানোর জন্য বর্তমান সময়ের বলের পরিবর্তে পাথর ব্যবহার করতো। আর হাতের কাছে ছিল বিভিন্ন ধরনের লাঠি। এই লাঠি দিয়ে পাথরকে আঘাত করে তারা খরগোশের গর্তে ফেলতো। এভাবেই তারা বিনোদন লাভ করতো এবং এক সময় এই খেলাটিই কালের বিবর্তনে বর্তমান সময়ের গলফ খেলা হিসেবে রূপ লাভ করে। ইংরেজি GOLF শব্দটি Gentlemen Only, Ladies Forbidden-এরই নাকি একটি অদ্যাক্ষর মিলিয়ে তৈরি।
গলফ খেলাটা আসলে কী?
এই ধরনের প্রশ্ন টিভি সেটের সামনে যখন বসে খেলাটি দেখা হয় তখন অনেকের মনেই উঁকি দেয়। আগেই বলেছি এটি হচ্ছে বল ও স্টিক এর সূক্ষ্ম দক্ষতার একটি খেলা। এই খেলার মূল লক্ষ্য স্টিক দিয়ে আঘাত করে বলটিকে গর্তের মধ্যে ফেলা। তবে একটি বা দুটি গর্তে নয়। পরপর ৯টি থেকে ১৮টি গর্তে বল ফেলতে হয়। তবেই নির্ধারিত হয় জয়-পরাজয়। খেলাভেদে ৯টি বা ১৮টি গর্তে বল ফেলতে হয়। যে খেলোয়ার সবচেয়ে কম শটে নির্ধারিত পরিমাণ গর্তে বল ফেলতে পারে তিনিই বিজয়ী হন।
এবার আসা যাক গলফ মাঠের দিকে
ক্রিকেট-ফুটবল মাঠের নির্দিষ্ট সীমানা থাকলেও গলফ মাঠের কোনো সীমানা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক দূরে দূরে কিছু সীমানা নির্দিষ্টকারী ফ্লাগ দেখতে পাওয়া যায়। ক্রিকেট-ফুটবলের মতো গলফ খেলার মাঠকে মাঠ বলা হয় না। গলফ খেলার মাঠকে বলা হয় ‘কোর্স’ । পরপর অনেকগুলো গর্ত ও টি নিয়ে একটি গলফ কোর্স তৈরি হয়। ‘টি’ হলো যেখান থেকে খেলোয়াড়রা প্রথমবার বলে হিট করেন সেই জায়গাটিকে বুঝায়। এই ‘টি’ মূলত একটি বস্তু। মাটি থেকে বলটি কিছুটা উপরে রাখার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। এই ‘টি’ ও ‘গর্ত’ এর মাঝে যে জায়গাটুকু রয়েছে সেটিকে বলা হয় ‘ফেরাওয়ে’ বা ‘ভালো পথ’।
প্রতিটি গর্তের আশে পাশে বিভিন্ন ধরনের পতাকা দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোকে বলা হয় ‘রাফ’, ‘হ্যাজার্ডস’ ও ‘পাটিং গ্রিন’। আর গলফ কোর্সে যে উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো জায়গা দেখা যায় সেটিকে বলা হয় ‘ডগলেগ’। সাধারণত এই ‘ডগলেগ’ টি এলাকা থেকে ডান বা বাঁম দিকে বেঁকে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বাঁক একবার হয়ে থাকে। আবার অনেকক্ষেত্রে এই বাঁক দুবার হয়ে থাকে। দুবার বাঁক হলে তাকে বলে ‘ডাবললেগ’। সাধারণত গলফ কোর্সে ১৮টি গর্ত থাকে। আর যদি ৯ গর্তের কোর্স হয় তাহলে দুবার পাক দিতে হয়। মাঠে চলাচলের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় কিছু যান রয়েছে।
জয়-পরাজয়ের হিসাব
এক কথায় জয়-পরাজয়ের হিসাব নির্ধারণ করা হয়, কোন খেলোয়াড় সবচেয়ে কম শটে বল নির্দিষ্ট পরিমাণ গর্তে ফেলতে পেরেছে সেই হিসাবে। এর বাইরেও গলফ খেলার কিছু পয়েন্ট এর বিষয় রয়েছে। প্রতিটি গলফ কোর্সে শট সংখ্যার একটি আদর্শ মান দাঁড় করানো আছে। এটিকে বলে পার। আন্তর্জাতিক মানের গলফ কোর্সে এই পার হয় ৭১। এই পার হলো একজন গলফার কতবার বলে হিট করে টি থেকে গর্তে বল ফেলতে পারে তার হিসাব। আবার বিভিন্ন গর্তে বল ফেলার জন্য বিভিন্ন পারের সংখ্যা রয়েছে। টি থেকে গর্তের দূরত্বই পার এর সংখ্যা নির্ধারণ করে।
- পার-তিনের (তিন শটে বল গর্তে ফেলা) ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ২৫০ গজ।
- পার-চারের (চার শটে বল গর্তে ফেলা) ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ২৫১ গজ থেকে ৪৭৫ গজ।
- পার-পাঁচের (পাঁচ শটে বল গর্তে ফেলা) ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ৪৭৫ গজের বেশি।
- পার-পাঁচের বেশি (পাঁচ শটের বেশি শটে বল গর্তে ফেলা) ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ৬৫০ গজের বেশি হয়।
এছাড়া গলফ কোর্সে যে ঢাল রয়েছে তার উপর ভিত্তি করেও পারের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। তবে আন্তর্জাতিক মানের ১৮ গর্তের গলফ কোর্সে ৪ পারের ৩টি, ১০ পারের ৪টি এবং ৪ পারের ৫টি গর্ত থাকে। তবে এই বিভাজন সব সময় এক রকম হয় না। তবে সবক্ষেত্রেই সবমিলিয়ে ৭০, ৭১ কিংবা ৭২ পারের খেলা হয়ে থাকে। স্কোরিংটা নির্ধারিত হয় কোনো খেলোয়াড় ৭১ পারের বেশি শট খেলেছেন নাকি কম শট খেলেছেন সে হিসেবে।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই নির্ধারিত পারের চেয়ে কম শট খেলতে হবে। যদি প্রতিপক্ষ দুই খেলোয়াড় এর স্কোর সমান হয় তাহলে তাকে বলা হয় ‘হেলভড’ বা ‘ট্রাই’। এক্ষেত্রে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বেশি ‘হোল’ জয়ী খেলোয়াড়কে বিজয়ী করা হয়। ‘হোল’ বলতে বুঝায় ‘টি’ থেকে বল মেরে ১ পারেই বল গর্তে ফেলে দেওয়াকে। ‘পেনাল্টি’ নামক একটি বিষয়ও রয়েছে গলফে। গলফে পেনাল্টি ধরা হয় যখন একজন খেলোয়াড় বলে হিট করার পর বলটি হারিয়ে গেলে, কিংবা বল মাঠের বাইরে চলে গেলে, খেলার সরঞ্জাম বা ঘাস সরাতে গিয়ে বল নড়লে, ভুলক্রমে অন্য গলফারের বল মারলে। পেনাল্টি হিসেবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের পারের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
স্কোরিং
সব ধরনের গল্ফ খেলার মূল উদ্দেশ্য হল যথাসম্ভব কমবার বল মারা। “হোল ইন ওয়ান” বা “এস” হল যখন একজন গল্ফার টি থেকে বল মেরে একবারে গর্তে ফেলে। বিভিন্ন স্কোরের বিভিন্ন প্রতিশব্দ আছে।
সংখ্যাগত প্রতিশব্দ | কথ্য প্রতিশব্দ | সংজ্ঞা |
---|---|---|
−৪ | কন্ডর | পারের চেয়ে চারটি মার কম |
−৩ | অ্যালবাট্রাস | পারের চেয়ে তিনটি মার কম |
−২ | ঈগল | পারের চেয়ে দুটি মার কম |
−১ | বার্ডি | পারের চেয়ে একটি মার কম |
E | পার | পারের সমান |
+১ | বোগী | পারের থেকে একটি মার বেশি |
+২ | ডাবল বোগী | পারের থেকে দুটি মার বেশি |
+৩ | ট্রিপল বোগী | পারের থেকে তিনটি মার বেশি |
+৪ | কোয়াড্রুপল বোগী | পারের থেকে চারটি মার বেশি |
গলফের সরঞ্জামাদি
গলফ খেলতে প্রয়োজন হয় একটি দন্ডের ও একটি বলের। যে দন্ডটি দিয়ে বলকে আঘাত করা হয় সেটিকে বলা হয় ‘স্টিক’ বা ‘ক্লাব’। তবে এই স্টিক আবার বিভিন্ন ধরনের রয়েছে। যেমন – ড্রাইভার, উড, পাটার। ‘টি’ এলাকা থেকে লম্বা দূরত্বে বল মারার জন্য ব্যবহার করা হয় ড্রাইভার স্টিকটিকে। এটি সবচেয়ে বড় স্টিক। আর ফেরাওয়েতে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য ব্যবহার করা হয় উড স্টিক। আর সবুজ এলাকাতে বলে হিট করে গর্তে ফেলার জন্য ব্যবহার করা হয় পাটার স্টিকটিকে। একজন খেলোয়াড় তার পছন্দ অনুযায়ী স্টিক তৈরি করতে পারলেও সেগুলো গলফ খেলার নিয়ম মেনে তৈরি করতে হবে। না হলে পরবর্তীতে যদি কোনো ভুলত্রুটি ধরা পড়ে তাহলে খেলা থেকে বহিষ্কার করা হয়ে থাকে।
গলফের কিছু প্রচলিত টুর্নামেন্ট
পেশাদার গলফ প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে—ম্যচ প্লে ও স্ট্রোক প্লে। এ ছাড়া বগি প্রতিযোগিতা, স্কিন গেম, নয়-পয়েন্ট, ফোরবল, বেস্টবল ইত্যাদি নামে আরও কিছু উপ-আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক গলফও প্রচলিত।প্রতিবছর ‘মাস্টার টূর্ণামেন্ট’, ‘ইউ এস ওপেন’, ‘ওপেন চ্যাম্পিয়নশীপ’ ও পিজিএ চ্যাম্পিয়নশীপ নামে পুরুষদের চারটি মেজর অনুষ্ঠিত হয়। আর মেয়েদের মেজর অনুষ্ঠিত হয় ৫ টি।